কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রামুর জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের ধলিরছড়া এলাকা। ২০০৮ সালে মোটর শোভাযাত্রা করে শতাধিক চিহ্নিত সন্ত্রাসী নিয়ে বনাঞ্চলঘেরা ধলিরছড়া মৌজার ২৯ একর খাস জমি দখল করে নেন কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমল। ওই দিন শত শত লোকজনের উপস্থিতিতে কমল নিজেই ‘কক্সবাজার ক্রীড়া ও কারিগরি কলেজ’ নামে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন ওই এলাকায়।
১৫ বছর ধরে দখল করে রাখা সেই জমিতে কলেজ প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, উল্টো ১০ একরের বেশি খাস জমি প্লট আকারে বিক্রি করে হাতিয়ে নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা। তখন দখল করা জমি থেকে কেটে ফেলা হয় চার হাজারের বেশি সেগুন-গর্জনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা। এ নিয়ে তখন প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালক ও হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত সাইমুম সরওয়ার বলেছিলেন, এলাকার শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়নে তিনি সরকারি জমিতে ক্রীড়া ও কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরে জেলা প্রশাসন নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও বেদখল হওয়া সরকারি জমি উদ্ধার করতে পারেনি। এ নিয়ে কমলের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার বাগ্বিতণ্ডাও হয়েছে। অনেক কর্মকর্তা নাজেহালও হয়েছেন। ক্ষমতার দাপট আর সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জায়গাটি পাহারা বসিয়ে এত দিন ভোগদখল করে আসছিলেন সাবেক হুইপ।
রামু উপজেলা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ কয়েকজন নেতা বলেন, তিন দফায় সাইমুম সরওয়ার এ আসনের সংসদ সদস্য থাকাকালে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বহু জমি দখল করে নেন। এমনকি একটি ইটভাটাও দখল করে নেওয়া হয়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে সাইমুম সরওয়ারও আত্মগোপন করেন। এরপর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রামু উপজেলা প্রশাসন সাইমুমের দখলে থাকা প্রায় ২৯ একর সরকারি জমি উদ্ধার করে। তখন পাহাড়ের পাশে টাঙানো ‘কক্সবাজার ক্রীড়া ও কারিগরি কলেজ’ এর সাইনবোর্ডটি উপড়ে ফেলা হয়। তার পাশে টাঙানো হয় আরেকটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা আছে, ‘সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি, এই জমির মালিক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পক্ষে জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার। তফসিলভুক্ত জমিতে অবৈধভাবে ভোগদখল, কোনো প্রকার স্থাপনা করবেন না। করলে তাৎক্ষণিক উচ্ছেদসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আদেশক্রমে—জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার।’
৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে ওই জায়গায় গিয়ে দেখা গেছে, দখল করা বিরান ভূমির একপাশে চার কক্ষবিশিষ্ট টিনশেডের একটি পাকা ঘর তোলা হয়েছে। ঘরটি পাহারা দেন স্থানীয় আদর্শগ্রাম এলাকার এনামুল হক। মাঝখানে বিশাল খোলা মাঠ এবং মাঠের চারপাশে সবুজ বনাঞ্চল। মাঠের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে প্রায় ১০ একর বনাঞ্চলে তৈরি হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি।
এনামুল হক বলেন, ক্রীড়া ও কারিগরি কলেজের নামে জমিটি দখলের এক বছরের মাথায় বেশ কিছু জমি প্লট আকারে বিক্রি করা হয়। চার কক্ষের টিনশেডের ঘরে মাঝেমধ্যে সাবেক হুইপ কমল লোকজন নিয়ে এসে আড্ডা দিতেন।
৫৪ হাজার টাকার বিনিময়ে ৫ শতকের একখণ্ড বনভূমির দখলস্বত্ব কিনে আড়াই বছর আগে ঘর বানান চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা নজরুল ইসলাম। জোয়ারিয়ানালার বশির উল্লাহর কাছ থেকে তিনি এই জমি কিনেছেন বলে জানান। নজরুল বলেন, বশির কমলের লোক। আরও ৪০-৪৫ জনের কাছে দখলস্বত্ব বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেন শাহ আলম, আবদুস সালাম, আবছার কামালসহ কমলের বেশ কয়েকজন অনুসারী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও এক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, জায়গা দখলের এক বছরের মাথায় প্লট বানিয়ে অন্তত ১৫ একর জমি বিক্রি করেন সাবেক হুইপ। আগে সরকারি জায়গাটি বিএনপির এক নেতার দখলে ছিল। সম্প্রতি জায়গাটি উদ্ধার করা হলেও অবৈধ স্থাপনা (ঘরবাড়ি) উচ্ছেদ করা হয়নি। সাইমুম সরওয়ার আত্মগোপন করলেও তাঁর অনুসারীরা এলাকায় অবস্থান করে জায়গাটি পুনর্দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, ক্রীড়া ও কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠার নামে সাবেক সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার সরকারি জায়গাটি অবৈধভাবে দখল করেছিলেন। সম্প্রতি জায়গাটি উদ্ধার করে সেখানে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেদখলে থাকা জমিতে ইতিমধ্যে যেসব অবৈধ স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, তার সবটাই উচ্ছেদ করা হবে। দখলদারদের তালিকা তৈরি করে মামলা করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করেও সাইমুম সরওয়ারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আত্মগোপন করেন। তবে সরকারি জমি দখলের বিষয়ে সাইমুম সরওয়ার আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ক্রীড়া ও কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সরকারি জায়গাটি দখল করেছিলেন, যা বিএনপির এক নেতার (মাহবুবুর রহমান চৌধুরী) দখলে ছিল।
ফুটবল কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রস্তাব
কক্সবাজারের রামুর খুনিয়াপালং ইউনিয়নে ফিফার অর্থায়নে ‘বাফুফে সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ (ফুটবল কমপ্লেক্স) নির্মাণের জন্য ১৯ দশমিক ১ একর জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছিল। ২০২২ সালের ৪ জুলাই বাফুফের কাছে জমির দলিল হস্তান্তর করে জেলা প্রশাসন। ফিফার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফুটবল কমপ্লেক্সটি বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু বরাদ্দ করা জায়গাটি প্রতিবেশসংকটাপন্ন এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল হওয়ায় ১ সেপ্টেম্বর বিশেষ আদেশে তা বাতিল করা হয়।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব (যুগ্ম সচিব) মো. আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক আদেশে ওই বরাদ্দ বাতিল করা হয়। তবে ওই আদেশে হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমলের দখল করা রশিদনগর ইউনিয়নের ধলিরছড়া মৌজার পরিত্যক্ত ১৯ দশমিক ১ একর জায়গায় ওই সেন্টার স্থাপনের জন্য বিকল্প প্রস্তাব করা হয়।
সুত্র: প্রথমআলো
পাঠকের মতামত